মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর

madhyamik itihas chatirth adhyayer prashn uttar

পরীক্ষা প্রস্তুতি: মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর। মাধ্যমিক ২০২৩ সালের পরীক্ষার্থীদের কাছে madhyamik  ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।  এই অধ্যায় থেকে প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে। তাই ২০২৩ সালের মাধ্যমিক পরিক্ষার্থীদের জন্য এখানে মাধ্যমিক ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায় থেকে অত্যন্ত গুরুত্বেপূর্ন ৪ নাম্বারের এবং ৮ নাম্বারের প্রশ্ন উত্তর গুলি আলোচনা করা হল। মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর।

Table of Contents

মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন ২০২৩

মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর

১)1857 খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কি ছিল?

উত্তরঃ  সূচনা: লর্ড ক্যানিং এর শাসনকালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহী ,রাজা, মহারাজা ও জনগণের অসন্তোষ কে কেন্দ্র করে যে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল তা ইতিহাসে সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ ছিল প্রত্যক্ষ কারণ।

সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ: এনফিল্ড রাইফেল নামে এক বিশেষ রাইফেলের ব্যবহার সেনাবাহিনীতে চালু করা হয়।এই রাইফেলের কার্তুজটি মোড়কের মধ্যে থাকত। সিপাহিদের দাঁত দিয়ে সেই মোড়ক কেটে কার্তুজ বের করে রাইফেলে ভরতে হত। 

এটা প্রচারিত হয় যে এই কার্তুজে গরুর ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি এর ফলে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান সিপাহীরা ধর্ম যাওয়ার ভয়ে গরু ও  শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়সিপাহীদে কার্তুজ ব্যবহারের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে এর ফলে আঠারোশ সাতান্ন খ্রিস্টাব্দের 29 শে মার্চ ব্যারাকপুর সেনা নিবাসের সিপাহী মঙ্গল পান্ডে কার্তুজ  ব্যবহার করতে অস্বীকার করে প্রতিবাদ জানালে বিদ্রোহের সূচনা হয়।

২)১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কিরূপ মনোভাব ছিল ?

উত্তর: সূচনা: 1857 খ্রিস্টাব্দের 29 শে মার্চ ব্যারাকপুর সেনানিবাসে বিদ্রোহ শুরু হলেও 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ খুব দ্রুত ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কেউ কেউ এই বিদ্রোহ কে সমর্থন করলেও অনেকেই এই বিদ্রোহের প্রতি সমর্থন জানান নি। 

বিশিষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের মনোভাব:

(ক) কিশোরী চাঁদ মিত্র  ছিলেন তৎকালীন একজন বিশিষ্ট শিক্ষিত বাঙালি। তিনি লিখেছেন 1857 সালের বিদ্রোহ ছিল মূলত সৈনিকদের বিপ্লব। এতে প্রায় এক লক্ষ সৈনিক অংশ নিয়েছিল এই বিদ্রোহের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক ছিল না।  (খ)তৎকালীন হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ চন্দ্র  মুখোপাধ্যায় একই কথা লিখেছেন।

(গ) দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময়ে বেরেলিতে নিযুক্ত একজন সামরিক কর্মচারী ছিলেন। তিনি বিদ্রোহীদের অত্যাচারের কাহিনী লিখেছেন এবং নিন্দা করেছেন। 

(ঘ)রাজনারায়ণ বসু 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় অন্যান্য শিক্ষিত বাঙ্গালীদের মত আতঙ্কিত ছিলেন এবং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন।

(ঙ)1857 খ্রিস্টাব্দে 26 শে মে কলকাতা হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা  এক সভার আয়োজন করে।  রাজা রাধাকান্ত দেব কালীপ্রসন্ন সিংহ হরেন্দ্র ঘোষ  এবং অন্যান্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সিপাহিদের নিন্দা এবং ইংরেজ সরকারকে  সাহায্যে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কেবল বিদ্রোহীদের নয় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ , নানাসাহেব ,লক্ষ্মীবাঈ, তাতিয়া টোপি প্রমূখ নেতা-নেত্রীদের প্রতি নিন্দা করা হয়। 

৩)১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। 

উত্তরঃ সূচনা:1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে।  একদল  ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ বললেও অন্য আরেক দল এই বিদ্রোহকে  জাতীয় আন্দোলন বলেছেন। আবার অনেকেই এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, সামন্ততান্ত্রিক প্রতিবাদ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলিম চক্রান্ত ইত্যাদি বলে মনে করেছেন।

সিপাহী বিদ্রোহ: ইংরেজ ঐতিহাসিক চার্লস রেক  এবং ভারতীয় ঐতিহাসিক কিশোরী চাঁদ মিত্র , দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।  তাদের মতে১৮৫৭খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চালিকাশক্তি ছিল সিপাহীরা। তাদের অসন্তোষ থেকেই এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই বিদ্রোহে  অংশ নেয়নি। তাই তাদেরমতে এই বিদ্রোহ ছিল সিপাহী বিদ্রোহ।

জাতীয় আন্দোলন: ঐতিহাসিক নর্টন , জন কে, কাল মার্কস প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে মনে করেছেন। তাদের মতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহ আন্দোলনে যোগদান করেছিল। বিদ্রোহীরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে ভারতবর্ষে এক নতুন শাসনব্যবস্থা স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিল।

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম: স্বাধীনতা সংগ্রামী সভারকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।

সামন্ততান্ত্রিক প্রতিবাদ: 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের্ কারন হিসেবে অনেকেই সামন্তদের অসন্তোষকে চিহ্নিত করেছেন।  ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই বিদ্রোহকে ভারতীয় সামন্তদের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ বলে অভিহিত করেছেন। 

মুসলিম চক্রান্ত: ঐতিহাসিক কুরেশি  এবং সৈয়দ মইদূর হক১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে মুসলিম চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন। 

মূল্যায়ন: হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলেই  মনে করেন।  তারা বলেন, এই বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিদ্রোহীদের দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না। 

৪)১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণগুলি কি ছিল?

উত্তরঃ সূচনা: 1857 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং এর শাসনকালে ভারতের বিস্তীর্ন  অঞ্চলে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, 1857 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যেই তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। 

1857 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের ব্যর্থতার প্রধান প্রধান কারণগুলি ছিল:-

(ক)সুনির্দিষ্ট লোকের অভাব: সিপাহিদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট লোকের অভাব ছিল।  বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য কোন কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না। এমনকি সিপাহিদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল প্রবল। এইসব কারণে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। 

(খ)আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা: 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের সর্বোচ্চ সম্প্রসারিত হয় নি।  কেবলমাত্র দিল্লি উত্তর প্রদেশ অযোধ্যা বাংলা বিহার প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।  দক্ষিণ ভারত ,কাশ্মীর, রাজপুতানা প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি।

(গ)নেতৃত্বের অভাব: 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সর্বভারতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো নেতা ছিল না। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ,লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং প্রমুখরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজ নিজ এলাকায় ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করা। তাছাড়া তাদের কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা ছিলনা। (ঘ)ইংরেজদের যুদ্ধ দক্ষতা : ইংরেজ সেনাপতি আউ ট্রাম , হ্যাভলক,হিউরোজ ,নিকলসন  প্রমূখ ছিলেন বিদ্রোহীদের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ। ইংরেজ সেনাপতিদের উন্নত রণ কৌশল এবং যোগ্য নেতৃত্ব তাদের জয় সুনিশ্চিত করেছিল। 

(ঙ)দেশীয় শক্তির বিরোধিতা : ভারতের আঞ্চলিক রাজ্য এবং শিক্ষিত ব্যক্তি এই বিদ্রোহের।  বিরোধিতা করেছিল তাই এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় এছাড়া বিদ্রোহীদের মধ্যে যোগাযোগের অভাব পরিচালনা অর্থের অভাব ইত্যাদি কারণে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। 

(৫)1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল আলোচনা করো। 

উত্তরঃ সূচনা: 1857 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ঐতিহাসিকদের মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের আকাশ থেকে বহু মেঘ দূর করেছিল। 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য ফলাফলগুলি ছিল–

(ক) কোম্পানি শাসনের অবসান: 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে।  কোম্পানির বদলে ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। ভারত শাসনের জন্য রাজপ্রতিনিধি ভাইসরয় নিযুক্ত হন।  1858 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন পাস হয়। 

(খ)ক্ষয়ক্ষতি : বিদ্রোহের সময় ব্যাপক হত্যাকান্ড এবং সম্পত্তি ধ্বংসের ফলে ভারতীয় রাজকোষের প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। 

(গ)শাসন কাঠামো পরিবর্তন: ভারতে শাসন কার্য পরিচালনার জন্য ইংল্যান্ডের মহারানী 15 জন সদস্যের একটি কাউন্সিল গঠন করেন। এই কাউন্সিলের সভাপতি হয় ভারতীয় সচিব। এছাড়া সেনাবাহিনীতে পাঠান,গোর্খা , শিখ প্রভৃতি সম্প্রদায় কে নিয়োগ করা হয়। 

৪)মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র: উন্নত ভারত শাসন আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৮৫৮  খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর মহারানীর ঘোষণাপত্র পাশ  করা হয়। এই ঘোষণাপত্রের দ্বারা ভারতের বিভিন্ন অসন্তোষ দূর করার চেষ্টা করা হয়।  

৬)মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র(১৮৫৮) ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি ? 

অথবা , টিকা লেখা : মহারানীর ঘোষণা পত্র। 

উত্তর : সূচনা : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমন করার পর ব্রিটিশ কতৃপক্ষ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ভারতের শাসনভার রাখতে চায়  নি।  ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের পরিবর্তে ভারতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ভারতে উন্নত ধরনের শাসন ১৮৫৮’ পাস করে।  এর মাধ্যমে ভারতের শাসন ক্ষমতা মহারানী ভিক্টোরিয়া হাতে তুলে দেওয়া হয়। 1857 খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর মহারানীর ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। 

মহারানীর ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্য: মহারানীর ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে –

ক)ভারতবাসীর  ধর্মীয়-সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার কোন রকম হস্তক্ষেপ করবে না। 

খ)জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতবাসী সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবে। 

গ)স্বত্ববিলোপ নীতি প্রত্যাহার করা হবে এবং দেশীয় রাজারা দত্তক পুত্র গ্রহণ করতে পারবেন। 

ঘ)সরকার ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি ত্যাগ করবে। দেশীয় রাজাদের আশ্বাস দিয়ে  ঘোষণা করা হয় যে, কোম্পানির সঙ্গে তাদের স্বাক্ষরিত চুক্তি মেনে চলা হবে। 

তাৎপর্য বা গুরুত্ব: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে  মহারানীর ঘোষণাপত্র পাশ  করা হলেও তা সঠিকভাবে পালিত হয়নি। নিম্নরূপ ক্ষেত্রগুলিতে মহারানীর ঘোষণাপত্র ব্যর্থ হয়-

ক)এই ঘোষণা পত্রের  দ্বারা  ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহের কারণগুলি উপলদ্ধি করতে পারলেও তার প্রতিকারের জন্য সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। 

খ) দেশীয় রাজাদের সুশাসনের অধিকার দেওয়া হলেও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধে ভাইসরয় এর  সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ঘোষণা করা হয়। 

গ) এই ঘোষণাপত্রের দ্বারা শিক্ষিত  শ্রেণীর দাবি যাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। 

ঘ)এই  ঘোষণাপত্রের দ্বারা পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী শাসনের মূল চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি।

উপরিক্ত কারণগুলির জন্যই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মহারানীর ঘোষণাপত্রকে  ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের’ সূচনা  বলে চিহ্নিত করেছেন। বিপিনচন্দ্র পাল এই ঘোষণাপত্র কে রাজনৈতিক ধাপ্পা বলেছেন। 

৭)ভারতের সভা সমিতির যুগ বলতে কি বোঝ?

অথবা, সভা সমিতির যুগ এর বৈশিষ্ট্য গুলি লেখ। 

উত্তরঃ সভা সমিতির যুগ:  ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে শাসন-শোষণের প্রতিক্রিয়ায় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ফলে দেশে একটি শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে ওঠে। তারা নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন সভা সমিতি গড়ে তুলেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতের প্রেসিডেন্ট শহরগুলিতে এইসব সভা সমিতি গড়ে ওঠার জন্য ঐতিহাসিক  ড. অনিল শীল  এই সময়কে সভা সমিতির যুগ বলে অভিহিত করেছেন।

সভা সমিতির যুগের বৈশিষ্ট্য: এই যুগের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল-

১)ঐক্য ভাব : এ দেশের শিক্ষিত শ্রেণী গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী ছিল।ইংরেজ শাসনে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য ভাব বজায় রাখে। 

২)এলিট  চরিত্র : এলিট বলতে  শিক্ষা দীক্ষায় আলোকিত শ্রেণীকে বুঝানো হয়। সভা সমিতির যুগে সভা সমিতির সদস্য রূপে কোন সাধারন মানুষ জন ছিল না। সবাই ছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। 

৩)রাজনৈতিক চেতনা:ইংরেজ সরকারের শাসন কর , মুদ্রাস্ফীতি ,শোষণ ও বৈষম্য নমধ্যবিত্ত  শ্রেণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সভা-সমিত গুলি  তাই জন স্বার্থের কথা চিন্তা করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। 

৪) শিক্ষার প্রসার: প্রথমদিকে সভা সমিতির সদস্যরা ব্রিটিশ শাসনের অন্ধ সমর্থক ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাদের মোহভঙ্গ ঘটে. তাই তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার  প্রসারের জন্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। 

৮) বঙ্গভঙ্গ বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন?

অথবা,  বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর। 

উত্তরঃ  সূচনা: উনিশ শতকে বাংলায় বেশকিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জন্ম হয়েছিল, তাই ঐতিহাসিক অনিল শীল উনিশ শতককে সভা সমিতির যুগ বলে অভিহিত করেছেন।  এই সভা-সমিতি গুলির মধ্যে সর্বপ্রথম১৮৩৬খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা। তাই বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা কে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়। 

প্রতিষ্ঠাতা : এই সভার প্রতিষ্ঠাতা দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন টাকির জমিদার কালিনাথ রায় চৌধুরী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ,প্রসন্নকুমার ঠাকুর ,গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং রামমোহন রায়ের শিষ্যবৃন্দ।  

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য: ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর গৌরীশংকর ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে এই সভার প্রথম অধিবেশন বসে।  সেই অধিবেশনে এই সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য গুলি সম্পর্কে বলা হয়-

১) সরকারি শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা 

২)  জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদন পত্র পেশ করা। 

কার্যাবলী: ১) বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভায়  সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হতো.

২)সরকারের দ্বারা সাধারণ জনগণের উপর চাপানো বিভিন্ন কর ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা হত। 

৩) পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে এই সভা  বিভিন্ন  উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।  

৯)টীকা লেখ জমিদার সভা। 

অথবা, জমিদার সভা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর। 

উত্তর: সূচনা: উনিশ শতকে বাংলায় অনেক সভা সমিতি গড়ে উঠেছিল , এগুলির মধ্যে 1838 খ্রিষ্টাব্দের 12 ই নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত জমিদার সভা ছিল অন্যতম। 

প্রতিষ্ঠাতা: জমিদার সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেই প্রধান ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ,প্রসন্নকুমার ঠাকুর ,ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ।

উদ্দেশ্য: জমিদার সভার সভাপতি ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব। তবে জমিদার সভার প্রাণ পরুষ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে। তাদের মতে জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য গুলি ছিল-

১) জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা করা। 

২)বিচার  বিভাগ,পুলিশ বিভাগ এবং রাজস্ব বিভাগের সংস্কার সাধন পড়ার জন্য আন্দোলন করা।

৩)ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের  চেষ্টা করা। 

কার্যাবলী :

১) জমিদার সভা ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানোর দাবি করেছিল। 

২)জমিদার সভা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শাখা স্থাপন করে বিভিন্ন অঞ্চলের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হয়।  

৩)বিচার বিভাগ ,পুলিশ বিভাগ এবং রাজস্ব বিভাগের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যেই জমিদার সভা আন্দোলন চালায়। 

১০)ভারত সভার প্রতিষ্ঠা ও কর্মসূচি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর। 

অথবা, রাজনৈতিক সমিতি হিসাবের বিবরণ দাও।  অথবা টিকা লেখ:ভারত সভা (1876)

উত্তরঃ সূচনাঃউনিশ শতকে যেসব রাজনৈতিক সমিতি গড়ে উঠেছিল , সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ভারত সভা। 1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই কলকাতার এলবার্ট হলে ভারত সভা বা ‘Indian Association’ প্রতিষ্ঠিত হয়।  

প্রতিষ্ঠাতা : প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।তাঁর সহযোগী ছিলেন আনন্দমোহন বসু , শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ। 

উদ্দেশ্য: ভারত সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি  ছিল-

১) দেশে জনমত গঠন করা। 

২) রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করা। 

৩) হিন্দু- মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে তোলা। 

৪) রাজনৈতিক আন্দোলনে অশিক্ষিত জনগণের যোগদানের ব্যবস্থা করা। 

কার্যাবলী : মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত ভারত সভা। তাই এই সভা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। যেমন-

১) ব্রিটিশ সরকার Indian  Civil Service(ICS) পরীক্ষার্থীদের বয়স 21 থেকে কমিয়ে 19 বছর করেছিল।  এর প্রতিবাদে ভারত  সভা আন্দোলন শুরু করে। ভারত সভার আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্ট্যাটুটারি  সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়। 

২)লর্ড লিটন দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন এবং অস্ত্র আইন পাস করলে ভারত সভা  প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ভারত সভার আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ সরকার 1883 খ্রিস্টাব্দে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। 

৩) বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় এবং ইউরোপীয় বিচারকদের সমান মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ভারত সভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের কারণেই ব্রিটিশ সরকার ইলবার্ট বিল পাস করতে বাধ্য হয়।  এই বিলের মাধ্যমে ভারতীয় বিচারকরা ইংরেজ অপরাধীদের অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা লাভ করে। 

১১)ভারত সভার প্রতিষ্ঠা ও  বিকাশে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান লেখ। 

উত্তরঃ সূচনা: উনিশ শতকে ভারতে  ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে যে সকল সংগঠন গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন ছিল ভারত সভা।  1876 খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ,শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখদের উদ্যোগেই ভারত সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। 

ভারত সভা প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান:

১) বিভিন্ন সভা সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে তিনি ভারত সভার কর্মকাণ্ডের কথা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। 

২)তার উদ্যোগে সমগ্র বাংলা,লক্ষ্নৌ ,মিরাট  প্রভৃতি স্থানে ভারত সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। 

৩)তিনি  সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা, ইলবার্ট বিল,অস্ত্র আইন, দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন প্রভৃতি বিষয়ে  বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে জনমত গ্রহণ করেন। 

৪)1883 খ্রিস্টাব্দে তার উদ্যোগে কলকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে একপ্রবল জনমতের  সমর্থনে 1885 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পথ অনেকটা সুগম হয়। 

মাধ্যমিক ইতিহাস ততৃতীয় অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তরের জন্য এখানে CLICK করুন। 

১২)টীকা লেখ: ইলবার্ট বিল অথবা ভারতের জাতীয়তা বোধের বিকাশে ইলবার্ট বিল এর গুরুত্ব। 

উত্তর: সূচনা: ভারতের বড়লাট লর্ড রিপনের উদারনৈতিক সংস্কার গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইলবার্ট বিল। লর্ড রিপন এর আইন সচিব কোর্টলি  ইলবার্ট একটি আইনের খসড়া তৈরি করেন যা তার নাম অনুসারে ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত হয়।

ইলবার্ট বিল এর বিষয়বস্তু: 1873 খ্রিস্টাব্দের  ফৌজদারি আইন বিধি অনুযায়ী ভারতীয় বিচারকেরা কোনো ইউরোপীয়র বিচার করতে পারত না। এই বৈষম্য দূর করার জন্য লর্ড রিপন ইলবার্ট বিল পাশ করেন। এই বিলের দ্বারা ভারতীয় বিচারকরা যে কোন ইউরোপীয় লোকের অপরাধের বিচার করার অধিকার লাভ করে। 

ইউরোপীয়দের আন্দোলন: ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিলের প্রস্তাবে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়।  এই বিল তাদের  মর্যাদায় প্রবল ভাবে আঘাত করে।  কারণ তারা মনে করতো ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয় লোকদের বিচার করার কোন যোগ্যতা নেই।  এর ফলে ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিল এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সভা নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে প্রবল আন্দোলন শুরু করে। 

জাতীয়তা বোধের বিকাশে ইলবার্ট বিল: ভারতীয়রা ইলবার্ট বিল এর সমর্থনে বিভিন্ন জায়গায় মিটিং মিছিলের আয়োজন করতে থাকে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বে ভারত সভা ইলবার্ট বিল এর সমর্থনে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে।  এর ফলে ইলবার্ট বিল কে কেন্দ্র করে ভারতবাসীর মনে এক নব্য জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ হয়। 

ফলাফল বা  গুরুত্ব: শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ইউরোপীয়দের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে  এবং প্রস্তাবিত আইনটির বেশকিছু উদারনৈতিক দ্বারা সংশোধন করে। কিন্তু ইলবার্ট বিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধের বিকাশে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করেছিল। 

১৩) হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কি ছিল ?

অথবা , উনিশ শতকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের বিকাশে হিন্দু মেলার অবদান লেখ। 

উত্তরঃ সূচনা: ভারতীয়দের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। চৈত্র মেলা বা হিন্দু মেলা বাঙালির সামাজিক ,সাংস্কৃতিক এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।  বাংলা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয় বলে এই মেলাকে চৈত্র মেলা বলা হতো।  পরবর্তীতে মেলার আয়োজকগণ চৈত্র মেলার নাম পরিবর্তন করে হিন্দুমেলা নামকরণ করে। 

হিন্দু মেলার সূচনা:1867 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু মেলা শুরু হয়। 

হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠাতা : নবগোপাল মিত্র এবং রাজনারায়ণ বসু এই হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠা করেন।ঠাকুরবাড়ির সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মেলার আয়োজনে  সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। 

হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠার  উদ্দেশ্য: বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়েই হিন্দুমেলা চালু করা হয়। উদ্দেশ্যগুলি হল-

১) হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা। 

২)আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলা। 

৩)হস্ত শিল্পে উৎসাহ দান করা। 

৪)সাহিত্যচর্চায় উৎসাহদান করা। 

৫) বাঙ্গালীদের হীনমন্যতা দূর করা। 

৬)শরীরচর্চায় উৎসাহ দেওয়া ,প্রভৃতি। 

হিন্দুমেলার কার্যাবলী: উদ্দেশ্যগুলি সফল করার উদ্দেশ্যেই হিন্দুমেলা বিভিন্ন কার্যাবলী গ্রহণ করে। যেমন – ধর্ম ও ইতিহাস বিষয়ক বক্তৃতা, ছাত্রদের শরীরচর্চা প্রদর্শনী ,মেলা, গান-বাজনা, মাটির জিনিসপত্রের প্রদর্শনী , প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে হিন্দু মেলা অনুষ্ঠিত হতো। 

জাতীয়তাবোধের বিকাশ হিন্দুমেলার অবদান: 1867 থেকেই 1880 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট 14 বার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই অল্প সময়ের মধ্যে ও জাতীয়তা বোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে হিন্দুমেলা যথেষ্ট অবদান রেখেছিল। হিন্দুমেলা জনসমাবেশ এবং বক্তৃতা দিয়ে সাধারন জনগনের মধ্যে জাতীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। 

১৪) টীকা লেখ:আনন্দমঠ। 

অথবা,  আনন্দমঠ উপন্যাসটি কিভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তারে সহায়তা করেছিল।

উত্তরঃ সূচনা: ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিভিন্ন মনীষীদের লেখা বিভিন্ন উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আনন্দমঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় 1882 খ্রিস্টাব্দের 15 ডিসেম্বর। 

আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি: আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি হলো অষ্টাদশ শতকের সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। আনন্দমঠ -এ  ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের করুন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।  এছাড়া এই উপন্যাসের মূল চরিত্র সন্তান দল, যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা।

আনন্দমঠের জাতীয়তাবাদী ভাবনা: আনন্দমঠ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদল আত্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কার্যাবলীর বিবরণ আছে। এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সত্যানন্দ।  তার আহ্বানেরমাধ্যমেই  ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র পরাধীন দেশ মাতার লাঞ্ছিত রূপ  তুলে ধরেছেন।  তিনি দেশমাতার উদ্ধারের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত একদল মাতৃভক্ত সন্তানের কার্যকলাপ এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসে সর্বপ্রথম বন্দেমাতরম গানটি ব্যবহার করা হয়। 

মূল্যায়ন: ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ এবং বন্দেমাতরম গানটির অবদান অপরিসীম। এইজন্যই ঐতিহাসিক অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্কিমচন্দ্র কে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত জনক বলে অভিহিত।  করেছেন। 

১৫) টীকা লেখ: বর্তমান ভারত অথবা জাতীয়তাবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে বর্তমান ভারত গ্রন্থটির ভূমিকা লেখ। 

উত্তরঃ সূচনা: ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটি 1889 খ্রিস্টাব্দে উদ্বোধন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং 1905 খ্রিস্টাব্দে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

বর্তমান ভারত গ্রন্থটি গ্রন্থের বিষয় বস্তু : এই গ্রন্থের মূল বিষয় হল-সভ্যতার  বিভিন্ন পর্যায়ে  রাজশক্তির বর্ণনা। ভারতের সমাজ ,সংস্কৃতি, ধর্ম ও  রামকৃষ্ণের বাণী, ভারতীয় জীবন, আদর্শ। বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান কাল ,ব্রাহ্মণ আধিপত্য থেকে শূদ্র জাগরণ পর্যন্ত  ভারতীয় সমাজের  রূপরেখা এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে। 

এই গ্রন্থের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের বিকাশ: স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র দেশবাসীকে অখন্ড রূপে দেখেছিলেন। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি সমগ্র ভারতবাসীর  মাঝে ভ্রাতৃত্ব বোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন “ভুলিও না নীচ  জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর ,তোমার রক্ত, তোমার ভাই।’’ তিনি সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র দেশবাসীকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন-  “হে ভারত, ভুলিও না তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত।” 

১৬)টীকা লেখ: ‘গোরা’ উপন্যাস। 

অথবা, ‘গোরা’ উপন্যাস কিভাবে জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল আলোচনা কর।   (মাধ্যমিক  2022)

উত্তর: সূচনা : ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গোরা উপন্যাসটি।উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় 1910 খ্রিস্টাব্দে।

উপন্যাসের পটভূমি: বিশ শতকের প্রথম দশকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং এই আন্দোলনে অংশ নেন।এই সময় জাতীয় স্তরে শুরু হয় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।এই প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরা উপন্যাসটি রচনা করেন।

গোরা উপন্যাসে জাতীয়তাবাদী চেতনা : গোরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হল গৌড় মোহন বা সংক্ষেপে গোরা। এক আইরিশম্যান এর পুত্র হলেও গোরা তার নিজের পরিচয় জানতো না।সে নিজেকে ভারতীয় ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান বলে মনে করত কারন সন্তান হীন কৃষ্ণ দয়াল এবং আনন্দময়ীর কোলে গোরা বড় হয়েছিল।কলকাতার পার্শ্ববর্তী গ্রাম ঘুরে ঘুরে গোরা সেই গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখের খবর নিত। সেই সময় সে উপলব্ধি করে যে শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চেয়ে  এই গ্রামের সামাজিক বন্ধন অনেক বেশি শক্ত। শহরে সমাজ প্রয়োজনে মানুষকে সাহায্য করেনা।বিপদের সময় ভরসা দেয় না। এখানকার সামাজিক আচার বিচার মানুষের মধ্যে শুধু বিভাজন তৈরী করে। গোরা এরকম সমাজের তীব্র নিন্দা জানান এবং সমস্ত ভারতীয় সম্প্রদায়কে  এক ছাতার তলায় আনার উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান- “ভারতবর্ষের সকল জাতি আমার জাত , সকলের অন্নই আমার অন্ন।”আহ্বানেই  ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে। 

১৭)উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে  ভারতমাতা চিত্রটির কি ভূমিকা ছিল ?

অথবা,  অবনীন্দ্রনাথ  ঠাকুরের ভারতমাতা চিত্রের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। অথবা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভারতমাতা চিত্রটির গুরুত্ব আলোচনা করো।

উত্তরঃ সূচনা: ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষের চিত্রশিল্পীরা বিভিন্ন চিত্রের মাধ্যমে ভারতের জাতীয়তা বোধ সৃষ্টি করেছিল। এই চিত্র গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি। 

সময়কাল: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1902 খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গমাতা’ চিত্র অঙ্কন করেন।পরবর্তীতে স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই চিত্রটি 1905 খ্রিস্টাব্দে ভারত মাতা নামে খ্যাতি লাভ করে। 

ভারতীয় জাতীয়তাবোধ  বিকাশে ভারতমাতা চিত্রটির গুরুত্ব: 

(ক)ভারতমাতা চিত্রটি আসলে হল গৌরিক বসন পরিহিত একজন দেবীর। এই দেবীকেই সমগ্র ভারত বাসি ভারতমাতা মনে করে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।  এই চিত্রটির মধ্য দিয়েই সমগ্র ভারতবাসীর মনে ভারত মাতার প্রতি এক তীব্র ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে।

(খ)ভারতমাতা ছবিটিতে  ভারতমাতা তার চারটি হাতে ধরে আছেন ধানের গোছা, শুভ্র বস্ত্র  এবং জপমালা। তার পায়ের চারপাশে আছে সাদা পদ্ম ফুল।এগুলি সব ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক ও  বাহক এবং প্রতীক হিসাবে  যুগে যুগে ভারতীয়দের কাছে সম্মানিত। তাই  ভারতমাতা ছবিটি ভারতীয় জনগণের মনে এক তীব্র জাতীয়তা বোধের সৃষ্টি করে। 

(গ)ভারতমাতা ছবিটি ছিল ভারতবর্ষের প্রতীক। তাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতমাতা ছবি কে সামনে রেখে সমগ্র ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। 

১৮)গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা  চিত্র গুলি সম্পর্কে আলোচনা কর। 

উত্তরঃ সূচনা: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারের একজন অন্যতম সদস্য। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রকর এবং ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী। তাকে আধুনিক চিত্রশিল্পের পথিকৃৎ বলা হয়। তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যৌথভাবে 1907 খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ অরিয়েন্টাল আর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। 

উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র গুলি হল-খল ব্রাহ্মণ, প্রচন্ড মমতা ,জাতাসুর, চৌষট্টি হাজার ,অদ্ভুত লোক প্রভৃতি। 

জাতীয়তাবোধের বিকাশে ব্যঙ্গ চিত্র গুলির গুরুত্ব : গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার  ব্যঙ্গচিত্র গুলির মাধ্যমে তৎকালীন ভারতীয় ধনী এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের ক্রিয়া-কলাপ নিয়ে নানা ব্যঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেন। তিনি চিত্রের মাধ্যমে সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি  ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যঙ্গচিত্র গুলির মাধ্যমে। ‘খল ব্রাহ্মণ’ ব্যঙ্গ চিত্রের  মাধ্যমে তিনি সমাজের ভন্ড ধার্মিকদের সমালোচনা করেছেন।  অন্যদিকে ‘চৌষট্টি হাজার’ ব্যঙ্গ চিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকদের বেতন  নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। 1919 খ্রিস্টাব্দের আঁকা ‘প্রচন্ড মমতা’ ব্যঙ্গ চিত্রের  মাধ্যমে তিনি সাধারণ ভারতীয়দের উপর ব্রিটিশ  সরকারের নির্মম অত্যাচারের কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন , যা ভারতবাসীকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তা করেছিল।

আরো পড়ুনঃ 
মাধ্যমিক বাংলার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর ২০২৩
মাধ্যমিক ইংরেজি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর ২০২৩
মাধ্যমিকইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর ২০২৩

1 thought on “মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর”

  1. I was very happy to uncover this great site. I need to to thank you for your time for this particularly wonderful read!! I definitely loved every little bit of it and I have you book marked to see new information on your web site.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *